লালকমল নীলকমল গল্পের ছবি – Thakurmar-Jhuli

ঠাঁকুরমার ঝুলি | Thakurmar Jhuli: ৫টি জনপ্রিয় গল্প ও বাংলা রূপকথার অনন্য ভান্ডার

ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ “ঠাঁকুরমার ঝুলি”। শিশুদের শোবার সময় দিদা-ঠাকুরমার মুখে শোনা এই গল্পগুলো আজও সমান জনপ্রিয়। এগুলো শুধু গল্প নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, নৈতিক শিক্ষা এবং কল্পনার ভুবনকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে। ডাক্তার দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ১৯০৭ সালে প্রথমবার এই গল্পগুলো সংকলন করে প্রকাশ করেন।

এই নিবন্ধে আমরা পড়ব ৫টি জনপ্রিয় গল্প

  1. লালকমল নীলকমল (লালকমল নীলকমল)
  2. খীরের পুতুল (খীরের পুতুল)
  3. বুদ্ধিরাম শিয়াল (বুদ্ধিরাম শিয়াল)
  4. সুখু দুখু (সুখু-দুখু)
  5. ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী (ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী)

লালকমল নীলকমল (Lalkamal Neelkamal) – বাংলা গল্প

অনেকদিন আগে, এক রাজ্যে এক নিষ্ঠুর রাক্ষস বাস করত। তার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল – সে মানুষ ধরে নিয়ে যেত আর মেরে ফেলত। রাজ্যের লোকেরা ভয়ে দিন কাটাত।

রাজা, রানি ও তাদের সন্তান

সেই রাজ্যে ছিলেন এক দয়ালু রাজা ও রানি। তারা অনেকদিন ধরে সন্তানহীন ছিলেন। একদিন রানি স্বপ্ন দেখলেন, স্বপ্নে এক দেবী এসে তাকে দুটি ফুল দিলেন—একটি লাল পদ্ম আর একটি নীল পদ্ম। দেবী বললেন,
“তুমি এই দুটি ফুল খাও। তোমার কোল আলো করবে দুই রাজপুত্র।”

রানি স্বপ্নের কথা রাজাকে বললেন। পরে সত্যিই তিনি দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। একজনের নাম রাখা হলো লালকমল, আরেকজনের নাম নীলকমল

দুষ্ট রাক্ষসের ফাঁদ

দুই রাজপুত্র বড় হতে লাগল। তারা সাহসী, দয়ালু এবং বুদ্ধিমান ছিল। কিন্তু যে রাক্ষস রাজ্যে সবার ক্ষতি করত, সে খবর পেল যে দুই রাজপুত্র জন্ম নিয়েছে। তার ভয় হলো—এই ছেলেরা একদিন তাকে মেরে ফেলবে।

সে ছলচাতুরি করে রাজাকে প্রভাবিত করল। একদিন সে রাজাকে বলল—
“মহারাজ, আপনার ছেলেদের যদি সত্যি বীর হয়, তবে তাদের এক বিপদজনক যাত্রায় পাঠান।”

অবুঝ রাজা রাজপুত্রদের বিপজ্জনক অভিযানে পাঠালেন।

রাক্ষসের গুহায়

লালকমল আর নীলকমল যাত্রা শুরু করল। পথে তারা অদ্ভুত সব প্রাণীর দেখা পেল। অবশেষে তারা পৌঁছাল রাক্ষসের গুহায়। সেখানে ভয়ঙ্কর দৃশ্য—চারিদিকে হাড়, রক্ত আর অন্ধকার।

রাক্ষস তাদের আটকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু নীলকমল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে এক পরিকল্পনা করল। তারা গুহায় লুকানো এক জাদুকরী অস্ত্র (একটি তলোয়ার) খুঁজে বের করল। এই অস্ত্র দিয়েই রাক্ষসকে পরাজিত করা সম্ভব।

রাক্ষস বধ

যখন রাক্ষস আক্রমণ করল, লালকমল শক্তি দিয়ে লড়াই শুরু করল, আর নীলকমল বুদ্ধি দিয়ে ফাঁদ পাতল। শেষে তারা সেই জাদুর তলোয়ার দিয়ে রাক্ষসকে হত্যা করল। রাজ্য আবার শান্ত হলো।

রাজ্যে ফেরা

রাজপুত্ররা রাজ্যে ফিরে এলো। রাজা-রানি আনন্দে ভরে উঠলেন। প্রজারা খুশি হয়ে উল্লাস করল। রাজ্য পেল শান্তি, নিরাপত্তা এবং ন্যায়।

রাজপুত্রদের নাম ইতিহাসে অমর হয়ে গেল—লালকমল আর নীলকমল

গল্পের মূল শিক্ষা:

  • সাহস আর বুদ্ধি একসাথে থাকলে যেকোনো অশুভ শক্তিকে পরাজিত করা যায়।
  • সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকা মানুষ সবসময় জয়ী হয়।

খীরের পুতুল (Kheerer Putul) – বাংলা গল্প

একদিন এক রাজ্যে ছিলেন এক মহারাজা ও তাঁর দুই রানি। বড় রানি ছিলেন অহংকারী আর ছোট রানি ছিলেন দয়ালু ও স্নেহময়ী। কিন্তু মহারাজা বড় রানিকে বেশি ভালবাসতেন। ছোট রানির প্রতি তিনি বিশেষ খেয়াল রাখতেন না।

ছোট রানির দুঃখ

ছোট রানির কোনো সন্তান ছিল না। তিনি সবসময় দুঃখে থাকতেন। বড় রানির অনেক চাকর-চাকরানী, ধন-সম্পদ, গহনা—সবকিছু থাকলেও ছোট রানির কপালে তেমন কিছু জুটত না। তবু ছোট রানি ছিলেন ভীষণ সৎ, স্নেহশীলা ও ধৈর্যশীলা।

দেবতার কৃপা

একদিন ছোট রানি এক মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করলেন—
“হে দেবতা, আমার কোনো সন্তান নেই, কোনো গহনা নেই, কিছুই নেই। শুধু আপনি আছেন। আমাকে একটু সুখ দিন।”

দেবতা তাতে খুশি হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করলেন। ছোট রানির কোল আলো করল এক মিষ্টি কন্যাশিশু দিয়ে। কিন্তু এটি ছিল সাধারণ শিশু নয়—একটি খীর দিয়ে তৈরি পুতুল। নাম রাখা হলো খীরের পুতুল

খীরের পুতুলের গুণ

এই পুতুল শুধু সুন্দরই ছিল না, বরং জীবন্তের মতো কথা বলত, খেলত আর হাসত। ছোট রানির জীবনে আনন্দ ফিরে এল। তিনি সারাদিন খীরের পুতুলকে কোলে নিয়ে রাখতেন।

বড় রানির হিংসা

বড় রানি এই সুখ সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন—
“আমার এত কিছু আছে, তবু রাজা ছোট রানির খীরের পুতুলকে নিয়ে খুশি। আমি কিছু একটা করব।”

তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। একদিন রাজাকে বললেন—
“মহারাজ, শুনেছি ছোট রানির মেয়ে সাধারণ নয়, বরং খীর দিয়ে গড়া। যদি খীরের পুতুল সত্যি এত সুন্দর হয়, তবে প্রমাণ করে দেখানো হোক।”

রাজা প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু বড় রানির কূটকচালে তিনি প্রভাবিত হলেন।

খীরের পুতুলের পরীক্ষা

রাজা ঘোষণা দিলেন—
“খীরের পুতুল যদি সত্যি বুদ্ধিমতী হয়, তবে সে নানা ধাঁধার সমাধান দেবে।”

খীরের পুতুল একে একে সব ধাঁধার উত্তর দিল। রাজা অবাক হলেন। তিনি বুঝলেন—এ মেয়ে সাধারণ নয়। কিন্তু বড় রানির হিংসা আরও বেড়ে গেল।

ষড়যন্ত্র ও বিপদ

বড় রানি চুপিসারে এক দাসীকে দিয়ে খীরের পুতুলকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রাসাদ থেকে দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর তাঁকে ফেলে আসা হলো বনে, যাতে wild প্রাণী খেয়ে ফেলে।

ছোট রানি কাঁদতে কাঁদতে দেবতার কাছে প্রার্থনা করলেন। তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দেবতা বন থেকে খীরের পুতুলকে উদ্ধার করে ফের প্রাসাদে ফিরিয়ে দিলেন।

সত্যের জয়

মহারাজ তখন সব সত্য জানতে পারলেন। তিনি বড় রানিকে শাস্তি দিলেন আর ছোট রানিকে প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিলেন। খীরের পুতুল রাজকন্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেল।

গল্পের শিক্ষা

  • হিংসা আর কূটকচাল কখনো জয়ী হয় না।
  • সৎ, দয়ালু আর ধৈর্যশীল মানুষের পাশে সবসময় ঈশ্বর থাকেন।
  • সত্যকে যতই লুকোনো হোক, একদিন না একদিন প্রকাশ হবেই।

বুদ্ধিরাম শিয়াল (Buddhiram Shiyal) – বাংলা গল্প

একসময় গভীর বনে থাকত এক চালাক শিয়াল। তার নাম ছিল বুদ্ধিরাম শিয়াল। সে আকারে ছোট হলেও মাথায় ছিল অসাধারণ বুদ্ধি। বনের সবাই জানত—যদি বিপদে পড়ে, তবে শিয়াল কিছু না কিছু বুদ্ধি বের করবেই।

বুদ্ধিরাম আর সিংহ

একদিন এক ক্ষুধার্ত সিংহ খাবারের খোঁজে বনে ঘুরছিল। সে কিছুই পাচ্ছিল না। হঠাৎ বুদ্ধিরাম শিয়ালকে দেখতে পেয়ে গর্জে উঠল—
“আজ তোকে খেয়েই পেট ভরাবো।”

শিয়াল তখনই মাথা খাটাল। সে ভয় পাওয়ার ভান করে বলল—
“মহারাজ, আপনি যদি আমাকে খান, তবে একদিনের জন্যই পেট ভরবে। কিন্তু আমি আপনাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারি যেখানে প্রচুর মাংস মেলে।”

সিংহ অবাক হয়ে বলল—“তুই কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?”
শিয়াল ফিসফিস করে বলল—“আমার সঙ্গে আসুন, তবে গোপন কথা কাউকে বলবেন না।”

কূটবুদ্ধির ফাঁদ

শিয়াল সিংহকে নিয়ে গেল এক গ্রামের দিকে। সেখানে ছিল গরু-ছাগল আর হাঁস-মুরগির ভরা মাঠ। শিয়াল বলল—
“দেখুন মহারাজ, এখানে চাইলে আপনি যত খুশি খাবার পেতে পারেন।”

সিংহ খুশি হয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ল। কিন্তু লোকেরা সিংহ দেখে লাঠি-সোটা নিয়ে আক্রমণ করল। সিংহ প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাল।

সিংহের রাগ

সিংহ বনে ফিরে এসে গর্জে উঠল—
“চতুর শিয়াল! তুই আমাকে ফাঁদে ফেলেছিস। আজ তোকে ছাড়ব না।”

কিন্তু বুদ্ধিরাম শান্ত গলায় বলল—
“মহারাজ, আমি আপনার ক্ষতি চাইনি। আমি তো ভেবেছিলাম সহজে খাবার পাবেন। তবে এবার আমি সত্যিই আপনাকে মাংস খাওয়াব।”

সিংহ আবার বিশ্বাস করল।

শিয়ালের শেষ বুদ্ধি

শিয়াল সিংহকে নিয়ে গেল এক কুয়োর ধারে। কুয়োর জলে ভেসে উঠছিল চাঁদের প্রতিচ্ছবি। শিয়াল বলল—
“মহারাজ, দেখুন! কুয়োর ভেতরে এক বিশাল মাংসের থালা রাখা আছে। আপনি চাইলে এক লাফে নেমে খাবার পেতে পারেন।”

সিংহ লোভ সামলাতে না পেরে কুয়োর ভেতরে ঝাঁপ দিল। কিন্তু ভেতরে তো শুধু জল! সিংহ সাঁতার জানত না, তাই ডুবে মরল।

বুদ্ধিরাম শিয়ালের জয়

শিয়াল দূর থেকে হেসে বলল—
“যে শুধু শক্তির উপর ভরসা করে, সে টেকে না। মাথা থাকলেই আসল জেতা যায়।”

এভাবেই বুদ্ধিরাম শিয়াল নিজের বুদ্ধি দিয়ে সিংহকে পরাজিত করল।

গল্পের শিক্ষা

  • শক্তির চেয়ে বুদ্ধি অনেক বড়।
  • লোভ মানুষকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়।
  • বিপদে শান্ত মাথায় ভাবতে পারলে সমাধান পাওয়া যায়।

সুখু দুখু (Sukhu Dukhu) – বাংলা গল্প

একসময় ছিল এক গরিব বৃদ্ধা মা আর তার দুই মেয়ে। দুই বোনের নাম ছিল—সুখু আর দুখু

  • সুখু ছিল সুন্দরী, তবে অলস, খিটখিটে আর স্বার্থপর।
  • দুখু ছিল রূপে সাধারণ, কিন্তু পরিশ্রমী, ভদ্র আর মিষ্টি স্বভাবের।

মা দুঃখুকে খুব ভালবাসতেন। সুখু তা সহ্য করতে পারত না। তাই সে সবসময় দুঃখুকে কষ্ট দিত।

দুঃখুর পরিশ্রম

প্রতিদিন দুঃখুকে ভোরে উঠতে হতো—গরু চরানো, কাঠ কাটা, নদী থেকে জল আনা, রান্না করা—সব কাজ একা তার ঘাড়ে পড়ত। সুখু সারাদিন অলস হয়ে বসে থাকত, আয়নার সামনে সাজগোজ করত।

তবুও দুঃখু মায়ের জন্য, সংসারের জন্য মন দিয়ে সব কাজ করত।

জঙ্গলে দুঃখু

একদিন মা দুঃখুকে জঙ্গলে কাঠ কুড়াতে পাঠালেন। দুঃখু কাঁদতে কাঁদতে জঙ্গলে গেল। সারা দিন খেটে কাঠ কুড়াল। তখন হঠাৎ সে দেখল এক বৃদ্ধা—ফাটা কাপড় গায়ে, মুখে ক্লান্তি।

বৃদ্ধা খাবারের জন্য অনুরোধ করলেন। দুঃখুর কাছে কিছুই ছিল না, শুধু সামান্য ভাত আর শাক। সে সেটাই ভাগ করে দিল।

বৃদ্ধা খেয়ে খুশি হয়ে বললেন—
“তুই দয়ালু মেয়ে, তোর জন্য আশীর্বাদ রইল।”

তারপর তিনি আসল রূপ ধারণ করলেন—তিনি ছিলেন দেবী!

আশীর্বাদ

দেবী দুঃখুকে বললেন—
“তুই যখনই কথা বলবি, তোর মুখ থেকে ফুল আর রত্ন বেরোবে।”

দুঃখু অবাক হলেও দেবীর আশীর্বাদ গ্রহণ করল।

সুখুর হিংসা

দুঃখু ঘরে ফিরে এল। সে যখন কথা বলল, তখন মুখ থেকে মুক্তো, হীরক, সোনার ফুল ঝরতে লাগল। ঘর ভরে গেল ধনে-রত্নে।

সুখু সেটা দেখে পাগল হয়ে গেল। সে বলল—
“আমি-ই আবার জঙ্গলে যাব। আমার মুখ থেকেও হীরে-মুক্তো বেরোতে হবে!”

সুখুর লোভ

পরের দিন সুখু জঙ্গলে গেল। দেবী আবার বৃদ্ধার রূপে তার সামনে এলেন। খাবার চাইলেন। কিন্তু সুখু বলল—
“আমি কি ভিখিরি নাকি? আমার খাবার আমি কেন ভাগ করব?”

দেবী তখনও তাকে সুযোগ দিলেন। কিন্তু সুখু অভদ্রভাবে ধমকালো। দেবী রেগে গেলেন।

অভিশাপ

দেবী বললেন—
“তুই লোভী আর স্বার্থপর, তাই তোর মুখ থেকে এবার থেকে বেরোবে বিষ আর কাঁকড়া।”

সুখু ভয় পেয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরল। কিন্তু সত্যিই তার মুখ থেকে কাঁকড়া আর বিষ ঝরতে লাগল।

পরিণতি

মা তখন বুঝলেন—দুখুর দয়া-ধৈর্যই তাকে ধন-সম্পদ দিয়েছে, আর সুখুর লোভ তাকে সর্বনাশে নিয়ে গেছে।

দুখু মায়ের সঙ্গে সুখে শান্তিতে থাকতে লাগল। তার মুখ থেকে ঝরতে থাকা ফুল আর রত্নে ঘর ভরে গেল আনন্দে।

গল্পের শিক্ষা

  • পরিশ্রমী আর দয়ালু মানুষ একদিন পুরস্কার পায়।
  • লোভ আর অভদ্রতা সর্বনাশ ডেকে আনে।
  • আসল সৌন্দর্য রূপে নয়, গুণে।

ব্যঙ্গমা–ব্যঙ্গমী (Byangoma–Byangomi) – বাংলা গল্প

অনেককাল আগে এক রাজ্যে এক রাজা থাকতেন। তাঁর অনেক ধনসম্পদ থাকলেও কোনো সন্তান ছিল না। দীর্ঘ প্রার্থনার পর অবশেষে রানির কোলে জন্ম নিল এক রাজপুত্র। রাজপুত্র ছিল চমৎকার সুদর্শন, সাহসী ও বুদ্ধিমান।

ভাগ্যের কথা

শিশুর জন্মের পর জ্যোতিষীরা রাজাকে বলল—
“মহারাজ, এই রাজপুত্র মহাবীর হবে, কিন্তু তার জীবনে এক বড় বিপদ আসবে। যদি সে কখনো ব্যঙ্গমা–ব্যঙ্গমী নামের দুই আশ্চর্য পাখির সাহায্য না পায়, তবে তার জীবন বিপন্ন হবে।”

রাজা ভয়ে সারা জীবন রাজপুত্রকে সুরক্ষায় রাখলেন।

অভিযানে রাজপুত্র

যখন রাজপুত্র বড় হলো, তখন সে বাবার কাছে অনুরোধ করল—
“আমি বাইরের দুনিয়া দেখতে চাই, শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে চাই।”

রাজা রাজি হলেন। রাজপুত্র বেরিয়ে পড়ল দুঃসাহসিক অভিযানে। পথে সে নানা বিপদ কাটিয়ে এগোল—দস্যুদের পরাজিত করল, বন্য পশু থেকে মানুষকে রক্ষা করল।

রাক্ষসের অভিশাপ

একদিন রাজপুত্র এক ভয়ঙ্কর রাক্ষসের কবলে পড়ল। রাক্ষস তাকে বন্দি করল এবং বলল—
“তুই আর বাঁচবি না। তোকে আমি খেয়ে ফেলব।”

রাজপুত্র প্রাণপণে লড়াই করল, কিন্তু রাক্ষস অতি শক্তিশালী। ঠিক তখনই আকাশ থেকে ভেসে এলো অদ্ভুত ডাক—
“ব্যঙ্গমা–ব্যঙ্গমী! ব্যঙ্গমা–ব্যঙ্গমী!”

ব্যঙ্গমা–ব্যঙ্গমীর আবির্ভাব

দুই আশ্চর্য পাখি নেমে এল—একজন ব্যঙ্গমা আরেকজন ব্যঙ্গমী। তারা ছিল অলৌকিক শক্তিধারী। মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারত।

ব্যঙ্গমা বলল—
“ভয় পাস না, রাজপুত্র। আমরা তোর সহায় হব।”

ব্যঙ্গমী তার ডানার ঝাপটায় এক ঝলক আলো ছড়াল। রাক্ষস চোখ ঝলসে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ল। রাজপুত্র সেই সুযোগে তাকে হত্যা করল।

রাজপুত্রের মুক্তি

রাক্ষস মারা যেতেই চারদিকে শান্তি নেমে এলো। ব্যঙ্গমা–ব্যঙ্গমী রাজপুত্রকে আশীর্বাদ করে বলল—
“তুই দয়ালু আর সাহসী। ভবিষ্যতে যত বিপদ আসুক, আমাদের নাম ডাকলেই আমরা তোকে রক্ষা করব।”

রাজপুত্র ধন্য হয়ে তাঁদের প্রণাম করল।

রাজ্যে ফেরা

রাজপুত্র সুস্থ–সবল হয়ে রাজ্যে ফিরে এলো। রাজা–রানি তাঁকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললেন। প্রজারা উল্লাসে ভরে উঠল। রাজপুত্র রাজ্য শাসন করলেন ন্যায় ও দয়ার সঙ্গে। আর তার পেছনে সবসময় ছিল দুই অলৌকিক রক্ষক—ব্যঙ্গমা ও ব্যঙ্গমী

গল্পের শিক্ষা

  • বিপদ যতই বড় হোক, সাহস হারালে চলবে না।
  • সত্যিকারের সাহায্য আসে তখনই, যখন মানুষ সৎ ও দয়ালু থাকে।
  • শক্তি একা নয়, ন্যায় ও সঙ্গত শক্তি মানুষকে জয়ী করে।

ঠাঁকুরমার ঝুলি সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

  • শিশুদের কল্পনা ও নৈতিক শিক্ষা গঠনে অপরিসীম ভূমিকা
  • বাংলার লোকসংস্কৃতির পরিচায়ক
  • প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গল্প শোনার ঐতিহ্য

FAQs (প্রশ্নোত্তর)

প্রশ্ন: ঠাঁকুরমার ঝুলি কে লিখেছিলেন?
উত্তর: ডাক্তার দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার।

প্রশ্ন: কোন কোন গল্প সবচেয়ে জনপ্রিয়?
উত্তর: লালকমল নীলকমল, খীরের পুতুল, সুখু-দুখু, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, বুদ্ধিরাম শিয়াল।

প্রশ্ন: শিশুদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: এগুলো শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, সততা, পরিশ্রম এবং সাহস শেখায়।

উপসংহার

ঠাঁকুরমার ঝুলি শুধু গল্পের ভান্ডার নয়, বরং বাঙালির শেকড়ের সাথে জড়িয়ে থাকা এক অমূল্য ধন। লালকমল নীলকমল থেকে শুরু করে খীরের পুতুল কিংবা ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী—প্রতিটি গল্প আজও শিশু ও বড় সবার মনে সমানভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *